Description
আমার ছিল কেবল একটা ছোট স্বপ্ন। সেটা অবশ্য এখনো রয়েছে।
'কিসসাওয়ালা' হবার স্বপ্ন।
হাটের এক কোনে বসে কিসসাওয়ালা গল্প শোনায়। ধুলোমাটিমাখা হাটফেরতা মানুষজন গালে হাত দিয়ে বসে সেই গল্প শোনে। কিন্তু যেসব আজব-মুলুকের গল্প সেই কিসসাওয়ালা শোনায়, সেসব মুলুকে সে নিজেই কখনো গিয়েছে নাকি? মোটেই না। সে তো সামনে বসে-থাকা ওই মানুষগুলোর মতনই দেহাতি। এদিকে নদী থেকে ওদিকে টিলা – এই তো তারও চেনাজানার চৌহদ্দি। তাহলে সে অত সাতসমুদ্র তেপান্তরের গল্প বলে কোথা থেকে?
শুনুন! মিথ্যের জাহাজ সেই কিসসাওয়ালা যা বলে সব বানিয়ে বলে। বানাতে বানাতে কখন যেন কিসসাওয়ালা নিজেও ভুলে যায় যে, সে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে। তার মনে হয়, সে সত্যিই বুঝি দেখেছে রকপাখির পায়ের নখ আঁকড়ে ধরে নাবিক সিন্দাবাদ উড়ে যাচ্ছে অন্য আরেক জাহাজডুবির দিকে। তার মনে হয়, সত্যিই যেন ফুল্লরা তার ক্ষুধার হাঁড়িতে সোনারঙ গোসাপের মাংস জ্বাল দিচ্ছে আর সোনার ফেনা উথলে উঠে ভরিয়ে দিচ্ছে কালকেতুর ঘর।
আমারও বানিয়ে-বানিয়ে গল্প লিখতে খুব ভালো লাগে।
হ্যাঁ, বানিয়ে।
হ্যাঁ, গল্প।
এখন নিজের লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছি – গত বারোবছরে ভাষা অনেকভাবে বদলে গিয়েছে। বদলে গেছে আঙ্গিক। কিন্তু দৈনন্দিনের খুঁটিনাটি বর্ণনা , যাকে বলে রিয়ালিস্টিক লেখা, লিখিনি কখনো। হঠাৎ করেই অদৃশ্য উপত্যকা থেকে মেঘ উঠে এসে ঢেকে দিয়েছে জলাপাহাড়ের রাস্তা। আমার গল্পে ঢুকে পড়েছে ফ্যানটাসি। আর যত পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করি না কেন, শেষ অবধি প্রায় সমস্ত ন্যারেটিভের মধ্যে একটা গোল গল্প বুনে দিয়েছি। পারলে শেষে রেখেছি চমক। সামনে বসে থাকা সমগোত্রীয় মানুষজনকে গল্প শুনিয়ে খুশি করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য -- না-ছিল কিসসাওয়ালার -- আর না-আছে আমার। অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে বোধহয় আমরা হাটের মধ্যে বসে গল্প শোনাতাম না।
সসঙ্কোচে আর একটা কথা বলি। আশৈশব আমার অল্পেই চোখে জল চলে আসে। গলার ভেতর অভিমান দলা পাকিয়ে ওঠে। জীবনে যে কষ্টগুলো পেয়েছি এবং পাচ্ছি, কাছের মানুষদের যে কষ্টগুলো পেতে দেখেছি এবং দেখছি, অর্থাৎ ‘এক্সপেরিয়েন্স’ এবং ‘ফেল্ট রিয়ালিটি’, তা হুবহু লিখতে গেলে আমি পারতাম না। আবেগ এসে আমার হাত থেকে কলম ফেলে দিত। তার চেয়ে এই ভালো। বিষফলের বীজগুলোকে আমি হাতের তালুতে নিয়ে কাউকে দেখাতে সাহস পাইনি। আমি তাদের বুকের মাটি থেকে কল্পনালতায় লতিয়ে উঠতে দিয়েছি। আশ্চর্য ব্যাপার, তবুও আমার পাঠকেরা যন্ত্রণাগুলোকে যন্ত্রণা বলে, বিষফুলকে বিষফুল বলে চিনতে ভুল করেননি।
...গত বারোবছরে বারবার এক সরাইখানা থেকে আরেক সরাইখানায়, এক তাঁবু থেকে ভিন্ন তাঁবুতে যাত্রা করেছে এই কিসসাওয়ালা। কোনো অভিলাষে নয়, কোনো অঙ্গীকারে নয় – শুধু ভিন্নতর আঙ্গিকের আনন্দের খোঁজে।"