‘তোমার বাড়ি আমার বাড়ি / নকশালবাড়ি নকশালবাড়ি’--- দেওয়াল লিখনগুলো অন্যান্য পার্টিগুলোর দেওয়াল লেখার মত একদম না। স্কুলের বন্ধু তন্ময়, দেবাঞ্জন, সাগ্নিক, সুদীপ্তদের মুখগুলো কেমন যেন পালটে যাচ্ছিল। অবাধ্য, বেপরোয়া, পুরনো সবকিছুকে ভেঙেচুরে বেরোতে চাইছিল যেন। ক্লাস নাইনের ছাত্র সুদীপ্ত, তার বাবা, বড়দা, স্কুল আর পাড়ার বন্ধুরা--- বলতে গেলে গোটা শহরটাই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল। সস্তার প্লাইকাঠের আলমারির মাথায় গোলকিপিং গ্লাভস তুলে রেখে, স্কুলের স্যরের লেভ ইয়াসিন বানানোর স্বপ্ন দূরে ঠেলে হাতে পাইপগান আর পেটো তুলে নিয়েছিল উত্তর কলকাতার একটি স্কুলের ছাত্র পুর্ণেন্দুও।
তারপর পোস্টার, লিফলেট, দেওয়াল লেখা, শ্লোগান, বোমা, গুলি, বন্দুক, অ্যাকশন, এনকাউন্টার, অ্যামবুশ, গোপন মিটিং... জ্বলন্ত সময়টাকে সারা গায়ে মেখে ছুটে চলা গোটা শহর জুড়ে। পুলিশ, সি আর পি, মিলিটারি, মাকু, নবকংগ্রেসি--- রাস্তায়, স্কুলে, পাড়ার মোড়ে, ফুটপাতে, অলিতে গলিতে সে এক ভীষণ লড়াই।
‘যত বড় তুমি হও / তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও
আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়--- এই শেষ কথা বলে / যাবো আমি চলে...’
শহীদ হবার চাকরি করতে নেমেছিল যেন সবাই। আসলে সময়টাই তো ছিল ওইরকম। চোখে একটাই স্বপ্ন--- গরীব মানুষের রাজ, ডিক্টেটরশিপ অফ দ্য প্রলেতারিয়েত।
রক্তগঙ্গা বইয়ে সেই দ্রোহের আগুন নিভিয়েছিল রাষ্ট্র। নিহত হাজার হাজার ছেলে। ফেরার আর কারারুদ্ধ তার প্রায় কয়েকগুণ। একদিন ঘরে ফিরল সবাই, যারা তখনও জীবিত। ব্যতিক্রম শুধু একজন। ঠিকানা, বন্ধু, মা, ছেড়ে আসা ছেলেবেলা, লেভ ইয়াসিন হতে চাওয়া গোলকিপিং গ্লাভস হারিয়ে ফেলার দুঃখে যে মানুষটা কষ্ট পায়, ঝরনা লাফিয়ে পড়া পুকুরে দু’ হাত ছড়িয়ে আলবাট্রাস পাখির মত সাঁতার কাটে, শিমুল তুলোর মতো প্রেমে পড়ে, নির্জন মাঝরাতে বেহালায় সুর তোলে--- ‘রহে না রহে হাম, মহকা করেঙ্গে / বনকে কলি বনকে শবা, গাতে রহেঙ্গে ...’
তিন যুগের বেশি সময় ধরে দীর্ঘ একটা রক্ত আর আগুনের নদী সাঁতরাতে সাঁতরাতে কোথায় এসে ঠেকল নৌকোটা? ডানা থেকে খসে, বীজ থেকে ফুটে উড়তে উড়তে এসে পড়েই সে ফের উধাও হয়ে যায়। কার আড়ালে আশ্রয় নেবে এক চোখে দেখা সেই স্বপ্নটা? ডানা ভেঙ্গে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে না তো কেতজেল?
শেষ পর্যন্ত কী হল সুদীপ্তর স্কুলের অভিন্নহৃদয় বন্ধু পুনের? সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়েই বিখ্যাত লেখক সুপ্রিয় চৌধুরীর এই অসাধারণ উপন্যাস